শক্রবার ২৮ নভেম্বার ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
রেগুলেটরি বডি

বেবিচকের বারবার চিঠি, তবুও ‘নো-ফ্লাই জোনে’ উঠেছে শত শত ভবন!

বার্তা ডেস্ক ০৭ সেপ্টেম্বার ২০২৫ ০৫:১৬ পি.এম

বেবিচক

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশেপাশে ‘নো-ফ্লাই জোন’-এ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর বারবার আপত্তি সত্ত্বেও শত শত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এই অবৈধ নির্মাণকাজ বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং বিমান চলাচলের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের মাঠে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। জনগণের অসচেতনতা এবং আইনের প্রতি অশ্রদ্ধার ফলে এসব দুর্ঘটনা আরও ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নিয়ম ভঙ্গ করে নির্মিত হয়েছে বহু ভবন

বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা, আশকোনা, উত্তরা, দক্ষিণখান এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বেবিচকের নির্ধারিত উচ্চতার সীমা লঙ্ঘন করে বহু ভবন নির্মিত হয়েছে। বেবিচকের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিমানবন্দরের আশপাশে প্রায় দেড় শতাধিক বহুতল ভবন রয়েছে, যা সঠিক জরিপ করলে ২০০ ছাড়িয়ে যাবে। যদিও এসব ভবন অপসারণে রাজউককে বহুবার চিঠি ও নোটিশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অবৈধ নির্মাণকাজ বন্ধ হয়নি এবং যথাযথ পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। এর ফলে বেবিচক অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে।

বেচিকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা সেই ১০ থেকে ১২ বছর ধরে রাজউককে বিভিন্ন সময়ে চিঠি ও নোটিশ দিয়েছি কিন্তু তারা তা আমলে নিচ্ছে না। তাদের অনুমতি ছাড়া তো এতগুলেো ভবন গড়ে ওঠেনি। 

অনুমোদনের প্রক্রিয়া ও নজরদারির অভাব

বিমানবন্দরের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে বেবিচকের অনুমতি নিতে হয়। বেবিচক বিমানবন্দরের দূরত্ব অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে অনুমতিপত্র দেয়। এরপর রাজউক এবং অন্যান্য দপ্তর থেকে অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ শুরু করতে হয়। বেবিচকের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাজউকের যথাযথ নজরদারি ও দেখভালের অভাবে এতসব বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে।

প্রত্যেকটি বিষয় আমরা (বেবিচক) অফিসিয়ালি রাজউককে জানিয়ে দেই। আমরা কিন্তু ভবন ভাঙতে পারি না। ক্যাব শুধু অনুমতি দেয়। কেউ ভবন করতে চাইলে কত তলার উচ্চতা পাবে তার জন্য অনুমতি দিলে তারা রাজউকে চলে যায়। আর বিল্ডিংয়ের পারমিশন দেয় রাজউক।

—কাওসার মাহমুদ, মুখপাত্র, বেবিচক

এ বিষয়ে কথা বলতে আমরা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

তবে বেবিচকের মুখপাত্র কাওসার মাহম এয়ারওয়েজ নিউজ বিডি কে বলেন, প্রত্যেকটি বিষয় আমরা (বেবিচক) অফিসিয়ালি রাজউককে জানিয়ে দেই। আমরা কিন্তু ভবন ভাঙতে পারি না। ক্যাব শুধু অনুমতি দেয়। কেউ ভবন করতে চাইলে কত তলার উচ্চতা পাবে তার জন্য অনুমতি দিলে তারা রাজউকে চলে যায়। আর বিল্ডিংয়ের পারমিশন দেয় রাজউক।

কেন এই নিয়ম?

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবন্দরের কাছাকাছি উঁচু ভবনগুলো উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় বিমানের জন্য মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে। জরুরি অবতরণ বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় এটি ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। অবৈধ ভবনগুলো বিমানবন্দরের রাডার এবং অন্যান্য নেভিগেশন সিস্টেমে সংকেত পাঠাতে ও গ্রহণ করতে বাধা দিতে পারে, যা বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণকে ব্যাহত করে।

এছাড়া, এই ভবনগুলো বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ এগুলো অপ্রত্যাশিত সন্ত্রাসী হামলা বা নাশকতার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। বিমানবন্দরের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ পরিকল্পনাতেও এই অবৈধ ভবনগুলি বাধা সৃষ্টি করছে।

বাধা ও চ্যালেঞ্জ

বেবিচকের নিয়ম অনুযায়ী, বিমানবন্দরের চারপাশে নির্দিষ্ট উচ্চতার বেশি কোনো কাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ। এই নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বেবিচক বহুবার স্থানীয় প্রশাসন, রাজউক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে অবৈধ নির্মাণ বন্ধের অনুরোধ করেছে। তবে, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এবং কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এই নির্মাণকাজ চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আমাদের এখানে তো অনেক জায়গায় আইন থাকে কিন্তু আইন না মানার প্রবণতা আমাদের মাঝে অনেক বেশি। নো ফ্লাইজোনে কী ধরনের স্থাপনা থাকবে, থাকবে না তা কিন্তু ক্লিয়ারলি মার্ক বলা আছে। এই বিষয়টি বেবিচক যেমন জানে তেমনি রাজউকও জানে।

—কাজী ওয়াহেদুল আলম, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ

ভবিষ্যৎ করণীয় ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন বিমান চলাচল নিশ্চিত করতে অবিলম্বে এই অবৈধ নির্মাণকাজ বন্ধ করা এবং নির্মিত অবৈধ ভবনগুলির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি সংস্থার সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন।

বেবিচকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উড়োজাহাজের নিরাপদ উড্ডয়ন ও অবতরণ নিশ্চিত করতে তারা প্রিয়াংকা হাউজিং সিটির ছয়টি বহুতল ভবনসহ ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত ভবনগুলোর অবৈধ অংশ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। ভবন মালিকরা উদ্যোগ না নিলে বেবিচক বিকল্প ব্যবস্থায় ভবন অপসারণের পদক্ষেপ নেবে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম এয়ারওয়েজ নিউজ বিডি কে বলেন, আমাদের এখানে তো অনেক জায়গায় আইন থাকে কিন্তু আইন না মানার প্রবণতা আমাদের মাঝে অনেক বেশি। নো ফ্লাইজোনে কী ধরনের স্থাপনা থাকবে, থাকবে না তা কিন্তু ক্লিয়ারলি মার্ক বলা আছে। এই বিষয়টি বেবিচক যেমন জানে তেমনি রাজউকও জানে।

‘কোনো ভবন তো একদিনই হয় না। একটি বহুতল ভবন হতে তো দীর্ঘদিন সময় লাগে। স্কুল, হাসপাতাল বা যে কোনো ভবনই হোক না কেন তা করতে তো অনেক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি লাগে। পারমিশন ছাড়া কি করে একটি বহুতল ভবন হয়ে যায়! রাজউজের পারমিশন ছাড়া কি করে একটি বহুতল ভবন ওঠে যায় সেটাও তো প্রশ্ন। এটা তো ভাববার বিষয়। বেবিচকের অনুমতি ছাড়া রাজউক কোনো প্লানকে পাস করার তো কথা নয়। আর যদি অতীতে সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে থাকে আর রাজউক বা বেবিচক যেই ঘটিয়ে থাকুক না কেন, এটা তো দুঃখজনক পরিস্থিতি,’ বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমরা যারা জনগণ তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা যদি নিজেরাই সচেতন না হই, তাহলে তো আমরা নিজেরাই তার ভুক্তভোগী হবো।

তার পরামর্শ হলো, বিমানবন্দর এলাকায় যেসব বহুতল উঁচু ভবন বেআইনিভাবে গড়ে উঠেছে সেগুলো চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে নোটিশ দিয়ে অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন ভবন নির্মাণ করতে না পারে সে ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে।